সৌদি আরব প্রতিনিধি ::
সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে বিতাড়নের সিদ্ধান্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে অনশন ধর্মঘট শুরু করেছে দেশটিতে আটক থাকা রোহিঙ্গারা। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আইকে দেওয়া সাক্ষাতকারে জেদ্দায় শুমাইসি আটক কেন্দ্রে থাকা রোহিঙ্গারা জানান, বাংলাদেশে যাওয়া ঠেকাতে অনশন করা ছাড়া তাদের ‘আর কোনও উপায় নেই।’
১৯৫১ সালে প্রণীত জাতিসংঘের রিফিউজি কনভেনশন অ্যাক্ট-এ স্বাক্ষর করেনি সৌদি আরব। শরণার্থী নীতির অনুপস্থিতিতে সেখানে থাকা শরণার্থীদের কাজের অনুমতি কিংবা চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হয় না দেশটির। দক্ষিণ এশিয়ার বাইরে সৌদি আরবেই সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। ১৯৭৩ সালে বাদশাহ ফয়সালের সময় মিয়ানমারে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গাদের সৌদি আরবে আশ্রয় দেওয়া হয়। সেদেশে জন্ম নেওয়া রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রেও একই নীতি অনুসরণ করা হয়। সৌদি আরবে থাকা রোহিঙ্গাদের জোর করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যাপারে ২০১৮ সালের অক্টোবরে দীর্ঘ চার মাসের অনুসন্ধান শেষ করে মিডল ইস্ট আই। ওই বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত মিডল ইস্ট আই’র প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোনও অভিযোগ ছাড়াই সৌদি আরবে বেশ কয়েক বছর ধরে আটক রাখা হয়েছে কয়েকশ রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুদের। এদের বেশিরভাগ ২০১১ সালের পর মিয়ানমারের নিপীড়ন এড়াতে ও জীবিকার তাগিদে তেল সমৃদ্ধ দেশটিতে পৌঁছায় ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে।
সম্প্রতি শুমাইসি আটক কেন্দ্রের প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, প্রতিদিনে খাবার না খেয়ে মেঝেতেই রেখে দিচ্ছেন রোহিঙ্গারা। ছড়িয়ে আছে রুটির ব্যাগ ও স্যুপ। সবাই নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। খাবার না খেয়েই জানাচ্ছে প্রতিবাদ।
নিরাপত্তার স্বার্থে ছদ্মনাম ব্যবহার করে তাদের কয়েকজনের বক্তব্য তুলে ধরেছে মিডল ইস্ট আই। জাহিদ নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, হোয়াটস অ্যাপসহ অন্যান্য অ্যাপের মাধ্যমে তার এই অনশনের আয়োজন করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন অনশন শুরু করি, তখন আমরা ৩০০ জন ছিলাম। এরপর আস্তে আস্তে অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
অনশনে অংশ নেওয়া একজন বৃদ্ধকে ইতোমধ্যে হাসপাতালে নিতে হয়েছে। জাহিদ বলেন, ‘আমরা জানি না আর কতদিন এই আন্দোলন চালাতে পারবো আমরা। তারা আমাদের খাওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’
রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে তাদের মোবাইল ফোনও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে জোর করে পাঠানোর সময় রোহিঙ্গা ভিডিওর মাধ্যমে নিজেদের বক্তব্য জানানোর পর এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।’
গত চারমাসে এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো অনশন শুরু করলো সেখানকার রোহিঙ্গারা। রাফিদ নামে এক রোহিঙ্গা বলেন, সৌদি কর্তৃপক্ষ স্বাধীনতার আশ্বাস দিয়ে গতবারের অনশন ভাঙিয়েছিলো। তারা জানিয়েছিলো, অনশন ভাঙা হলে অল্পসংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানো হব। তিনি বলেন, ‘অন্তত ৬০ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশিদের মতো করে ফেরত পাঠানো হয়। এটা দেখোর পর আমরা ফিরে যেতে চাই না। তারা বলেছিলেন আমাদের মুক্তি দিবেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউ এখান থেকে যেতে পারেনি। আমরা আপনাদের সাহায্য চাই। আমাদের এখান রাখবেন না।’
রাফিদ বলেন, ‘সম্ভব বলে জাতিসংঘ যেত আমাদের নিয়ে নেয়। এখানে অনেকই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কারও বাবা-মা মারা যাচ্ছে তো কারও ভাই মারা যাচ্ছে। এভাবে আর সহ্য করা যায় না। আমাদের আবারও অনশন শুরু করতে হয়েছে।’
এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কোনও মন্তব্য করেনি।
গত রবিবার শুমাইসি আটক কেন্দ্রে গোপনে ধারণ করা কিছু ভিডিও চিত্রের বরাতে তারা দাবি করেছে, বেশ ক’জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি অব্যাহত রেখেছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। রবিবার শুমাইসি আটক কেন্দ্রের রোহিঙ্গাদেরকে সারিবদ্ধভাবে প্রস্তুত করতে দেখা গেছে। যেসব রোহিঙ্গা এর বিরোধিতা করছিলো, তাদের হাতকড়া পরিয়ে রাখতেও দেখা গেছে ভিডিওতে।
নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌদি আরব সফরের কিছুদিন পরই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ঘোষণা দেয় সৌদি আরব। এর বিরোধিতা করে সৌদি অভিবাসন পুলিশের শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে তাদের। সৌদি আরবে প্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই ২০১২ সালে যায়। তখন রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার পর অপেক্ষাকৃত ভালো জীবন-যাপনের আশা নিয়ে তারা সৌদি আরবে পাড়ি জমিয়েছিল। সেখান থেকে তারা বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে থাকা পরিবারকে খোরপোষ জোগাচ্ছিলো।
পাঠকের মতামত: